নামাজের ভুলত্রুটি নিরসনে ‘সিজদায়ে সাহু’

দাঁড়ানো, কিরাত পড়া, রুকু করা ও সিজদা করা—এই চারটি নামাজের রুকন বা স্তম্ভ। কোনো ব্যক্তি নামাজের কোনো রুকন বাদ দিলে তার নামাজ বাতিল হয়ে যায়।

এই নামাজ আবার পড়া আবশ্যক। রুকন বাদ পড়ার কারণে নামাজে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা সাহু সিজদা ইত্যাদি দ্বারা পূরণ হয় না। একইভাবে নামাজের কোনো ফরজ কাজ ত্যাগ করলেও সাহু সিজদার মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ হয় না।
কোনো ব্যক্তি নামাজের কোনো ওয়াজিব কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিলে সে গুনাহগার হবে। তার নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে, আবার আদায় করতে হবে। এর শূন্যতাও সিজদায়ে সাহু দ্বারা পূর্ণ হবে না।

তবে হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি নামাজের কোনো ওয়াজিব ভুলক্রমে ছেড়ে দেয়, তার জন্য সিজদায়ে সাহু বা ভুলের সিজদা করা ওয়াজিব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৮৬; আবু দাউদ : ৮৭৪, আল-মুজামুল আওসাত : ৭৮০৮)

সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হওয়ার কয়েকটি দিক

১। যদি ফরজের প্রথম দুই রাকাত বা যেকোনো এক রাকাতে সুরা ফাতিহা পড়তে ভুলে যায়, তেমনি নফল ও বিতরের যেকোনো রাকাতে যদি ভুলক্রমে সুরা ফাতিহা পড়া না হয়, তখন সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে।

(মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৮৯৩)
২। যদি ফরজের প্রথম দুই রাকাতে কিরাত পড়া ভুলে যায় এবং শেষ দুই রাকাতে তা পড়ে, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/৪০৯)

৩। ফরজের দুই রাকাত বা এক রাকাতে কিরাত মেলাতে ভুলে গেলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (নাসায়ি, হাদিস : ১২৪৩)

৪। একই রাকাতে যদি সুরা ফাতিহা দুইবার পড়া হয়, তখন সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। কারণ সেখানে সুরা পড়ায় দেরি হয়ে গেছে। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৫; কিতাবুল আসার লি আবি ইউসুফ : ১৮৬)

৫। যদি এক সিজদা করে পরের রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তখন ওই রাকাতে দুই সিজদা সম্পন্ন করে ছুটে যাওয়া সিজদাও এর সঙ্গে মিলিয়ে নেবে। শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। তাতে নামাজ হয়ে যাবে। (প্রাগুক্ত)

৬। তেমনি যদি তিন বা চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজে প্রথম বৈঠক ভুলে যায়, তা ফরজ হোক বা নফল নামাজ, সিজদায়ে সাহু দিতে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৮৮২)

৭। যদি তাশাহহুদ পড়তে ভুলে যায়, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (নাসায়ি, হাদিস : ১২৪৩)

৮। বিতর নামাজে যদি কুনুতের তাকবির বলতে ভুলে যায়, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (নাসায়ি, হাদিস : ১২৪৩)

৯। যদি বিতর নামাজে তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে কুনুত পড়তে ভুলে যায়, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি : ৪০৪২)

১০। যদি ইমাম আস্তে পড়ার নামাজে কিরাত উচ্চৈঃস্বরে পড়েন অথবা জোরে পড়া নামাজে কিরাত অনুচ্চস্বরে পড়েন, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১/৩৬৩)

১১। যদি প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদের সঙ্গে দরুদ ইত্যাদি পড়ে ফেলে, তাহলে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৫)

সাহু সিজদা সম্পর্কে কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়

ইমামের ভুলের কারণে মুক্তাদিদের ওপরও সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব। আর মুক্তাদিরা ইমামের অনুসরণ করা অবস্থায় যদি কোনো ভুল করে, এতে তার সিজদায়ে সাহু দিতে হবে না। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি : ৪০৫০)

যদি ইমাম সালাম ফেরানোর পর মুক্তাদি তার নামাজ পূর্ণ করতে গিয়ে ভুল করে, তখন তাকে সিজদায়ে সাহু দিতে হবে। (নাসায়ি, হাদিস : ১২৪৩)

ইমামের ওপর সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হওয়ার কারণে সিজদায়ে সাহু করার সময় মুক্তাদিকেও ইমামের অনুসরণ করতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬৫; সুনানে কুবরা : ৪০৫০)

যে ব্যক্তির ওপর সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়েছে, যদি সে ইচ্ছাকৃতভাবে সিজদায়ে সাহু না করে তাহলে সে গুনাহগার হবে এবং নামাজ আবার পড়তে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৮৬১; বুখারি, হাদিস : ৬৭৩৭)

যে ব্যক্তির একই নামাজে কয়েকটি ওয়াজিব ভুলক্রমে ছুটে গেছে, সে ক্ষেত্রে একবার সাহু সিজদা দিলেই হবে। (আব্দুর রাজ্জাক : ২/৩২১)

যে ব্যক্তি ভুলক্রমে ফরজ নামাজে প্রথম বৈঠক না করে উঠে যায়, তখন সে যদি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে না যায় তাহলে আবার বসে যাবে। যদি দাঁড়ানোর কাছাকাছি উঠে যায়, তাহলে সাহু সিজদা দিতে হবে। যদি বসার কাছাকাছি থাকে, তাহলে সিজদায়ে সাহু দিতে হবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৮৭২)

যে ব্যক্তি নফল নামাজে প্রথম বৈঠক না করে উঠে যায়, সে আবার বসে যাবে; যদিও সে পরিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েই যায়। পরে সাহু সিজদা দেবে। তেমনি যে ব্যক্তি ফরজ নামাজের শেষ বৈঠকের কথা ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, সে আবার বসে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে পঞ্চম রাকাতের সিজদা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আবার বসে যাবে এবং সাহু সিজদা দেবে। (মুআত্তা মুহাম্মদ : ১/২২৫; কিতাবুল আসার : ১৮৬)

যদি পঞ্চম রাকাতের সিজদা করে ফেলে, তাহলে তার ফরজ নফল হয়ে যাবে। তখন জোহর, আসর ও এশায় আরো এক রাকাত পড়ে নেবে এবং ফজরেও আরো এক রাকাত পড়ে নেবে, যা নফল হয়ে যাবে। (আবু দাউদ : ৮৬৪; মুসনাদে আহমাদ ৪০০৬)

যে ব্যক্তি শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার পর এটিকে প্রথম বৈঠক মনে করে উঠে যায় তাহলে সে আবার বসে গিয়ে সালাম ফিরিয়ে নেবে। আবার তাশাহহুদ পড়বে না। (মুসনাদে আহমাদ : ৪০০৬)

যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সালাম ফিরিয়ে দেয় অথচ তার ওপর সিজদায়ে সাহু ছিল তাহলে সে ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদায়ে সাহু করতে পারে, যতক্ষণ নামাজের বিপরীত কোনো কাজ না করে; যেমন—কিবলা থেকে ফিরে যাওয়া, কথাবার্তা বলা ইত্যাদি। (বুখারি, হাদিস : ১১৫০; আব্দুর রাজ্জাক : ২/৩৫০)

যে ব্যক্তি চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ পড়ছিল, সে সালাম ফেরানোর পর মনে পড়ল সে শুধু দুই রাকাতই পড়েছে, তখন নামাজ বেনা করতে পারবে (অর্থাৎ বাকি দুই রাকাত পড়ে নেবে) এবং সিজদায়ে সাহু করবে। (আব্দুর রাজ্জাক : ২/৩১৩)

সাহু সিজদা আদায়ের পদ্ধতি

যার ওপর সাহু সিজদা ওয়াজিব হয়েছে সে শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া শেষ করে ডান দিকে এক সালাম ফেরাবে। তারপর তাকবির বলে নামাজের মতো দুটি সিজদা করে বসে যাবে এবং তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়ায়ে মাসুরা পড়ে সালাম ফেরাবে। সালামের আগে সিজদা করলে নামাজ হয়ে যাবে। তবে তা মাকরুহে তানজিহি। (মুসনাদে আহমাদ : ১৮১৮৮; বুখারি, হাদিস : ১১৫০, ১১৫৩; তিরমিজি : ৩৬১; সুনানে কুবরা : ২৯৬৮)

সাহু সিজদা কখন রহিত হয়

নিম্নলিখিত অবস্থায় সাহু সিজদা করতে হবে না—

১। জুমার নামাজে যদি লোকসমাগম অতিরিক্ত হয় তখন সাহু সিজদা করতে হবে না, যাতে মুসল্লিদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি না হয়। (আল-ফিকহুল ইসলামী : ২/২৬৫)

২। ঈদের নামাজেও লোকসংখ্যা বেশি হলে সাহু সিজদা দিতে হবে না। (আল-ফিকহুল ইসলামী : ২/২৬৫)

৩। ফজর নামাজে যদি সালাম ফেরানোর পরই সূর্য উদিত হয়ে যায়, তখন সাহু সিজদা দিতে হবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৪৮)

৪। আসর নামাজের সালাম ফেরানোর পর যদি সূর্য হলুদ বর্ণ হয়ে যায়, তখন সাহু সিজদা দিতে হবে না। উল্লিখিত অবস্থাগুলোতে নামাজ আবার আদায় করতে হবে না। (প্রাগুক্ত)

৫। সালাম ফেরানোর পর যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ হয়ে যায়, যেমন—সালাম ফেরানোর পর কথা বলে ফেলা, তখন সিজদায়ে সাহু দিতে হবে না। (বুখারি, হাদিস : ১১২৫)